Logoশরয়ী সমাধান
Cover image

প্রবন্ধ

কুরবানীর গোশত তিনভাগে বন্টনের হুকুম

Hm Sulayman

১১ জুন, ২০২৫

Share Copy Link

কিছুদিন বাদে কুরবানী। কুরবানির দিন আসলে প্রায় প্রতিটি এলাকায় একটি বদ প্রথা দেখা যায়। মানুষের বাড়ি বাড়ি থেকে গোস্ত সংগ্রহ করে অথবা মসজিদ থেকে মাইকে মাইকে বারবার ঘোষণা দিয়ে প্রত্যেক মানুষের গোশতের তিন ভাগের একভাগ মসজিদে জমা করা হয়। কোন কোন জায়গায় দেখা যায় যে কোন ব্যক্তি যদি তার অংশের গোশত থেকে মসজিদে না দিতে চায় তাহলে অনেক সময় তাকে নিন্দাবাদ জানানো হয় ,তাকে তিরস্কার করা হয় এবং অনেক সময় কোন কোন ব্যক্তিকে চাপ প্রয়োগ করা হয়। যার ফলে সামাজিকতা এবং চক্ষু লজ্জার কারণে মানুষ মসজিদে গোশত দিয়ে আসতে বাধ্য হয়। অতঃপর মসজিদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ সে গোশত ফকির মিসকিনদের মধ্যে এমনকি অনেক কোরবানি দাতার মধ্যেও বিতরণ করে থাকে।

সবার আগে আমাদেরকে একটা জিনিস বুঝতে হবেঃ কোরবানি করা আলাদা একটি বিধান আর কোরবানির গোশত দান করা ভিন্ন হুকুম। শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে কোরবানির গোশতকে তিন ভাগে ভাগ করা এটি মুস্তাহাব। অর্থাৎ সামর্থ্যবান ব্যক্তি তার গোশতকে তিন ভাগ করবে। এক অংশ গরিব-মিসকিন ও অসহায়দেরকে দান করা, এক অংশ গরীব আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া। আর এক অংশ নিজের জন্য রাখা। এটি হল মুস্তাহাব আমল অর্থাৎ যদি এরকম তিন ভাগে ভাগ করতে পারে তাহলে ভালো এবং সে অনেক সওয়াবের অধিকারী হবে আর যদি না করে তাহলে কোন প্রকার গুনাহ হবে না এবং শরীয়তের পক্ষ থেকে তাকে নিন্দা ও জানানো হবে না।

বরং, কোন ব্যক্তি যদি তার পরিবারের সদস্য বেশি হওয়ার কারণে তার কুরবানীর অংশের পুরো গোস্তটাই পরিবারের জন্য রেখে দেয় তাহলেও কোন প্রকার নূন্যতম সমস্যা নাই। এটি সম্পূর্ণ মুস্তাহাব একটি আমল এ ব্যাপারে কোন মানুষকে জোরাজুরি করা, চাপ প্রয়োগ করা সম্পূর্ণরূপে নাজায়েজ।

কোন মানুষের সম্পদ তার সন্তুষ্টি ব্যতিরেকে গ্রহণ করা শরীয়তে সম্পূর্ণ হারাম। আর এভাবে মসজিদে গোস্ত একত্রিত করে জমা করে সকলকে বিতরণ করা এটিও শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তম পদ্ধতি নয়। বরং কোরবানি দাতা নিজে সাধ্যমত পছন্দমত যাকে ইচ্ছা তাকে দান করবে এটি তার ইচ্ছাধীন।

অতএব এই নাজায়েজ পদ্ধতি থেকে বের হয়ে আসা আমাদের সকলের জন্য আবশ্যক।

বিষয়টি মাসিক আল কাউসার থেকেও বিস্তারিত দেখতে পারেন। সেখানের ফতোয়ায় বলা হয়েছেঃ

কোরবানি করা এবং কোরবানির মাংস দান করা ভিন্ন দুটি আমল। সওয়াবের নিয়তে পশু জবাইয়ের দ্বারা কোরবানির ওয়াজিব আদায় হয়ে যায়। আর কোরবানির মাংস বিতরণের ব্যাপারে ইসলামে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তবে তা বিতরণে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং দান করলে সওয়াব পাওয়া যাবে।

কুরবানী করা এবং কুরবানীর গোশত দান করা ভিন্ন ভিন্ন দুটি আমল। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইখলাসের সাথে পশু জবাই করার দ্বারাই কুরবানীর ওয়াজিব আদায় হয়ে যায়। আর কুরবানীকারীর জন্য তার কুরবানীর গোশতের ক্ষেত্রে শরীয়তের নির্দেশনা হল, সে নিজ পরিবার-পরিজনকে নিয়ে খাবে এবং পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, যারা কুরবানীর সামর্থ্য রাখে না তাদেরও দান করবে। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, (কুরবানীর গোশত) তোমরা খাও, জমা করে রাখো এবং (গরীব-অসহায়দেরও) দান করো।Ñহাদীসঃ ১৯৭১

অন্য বর্ণনায় আছে, তোমরা খাবে এবং অন্যদেরও খাওয়াবে। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীসঃ ১৯৭৩

তবে দানের ব্যাপারে কুরবানীকারীর উপর শরীয়ত কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করেনি; বরং প্রত্যেককে তার অবস্থা অনুপাতে দান করতে বলা হয়েছে। অবশ্য সামর্থ্যবানদের জন্য স্বাভাবিক অবস্থায় উত্তম হল, মোটামুটি তিন ভাগ করে এক অংশ গরিব-মিসকিন ও অসহায়দেরকে দান করা, এক অংশ গরীব আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া। আর এক অংশ নিজের জন্য রাখা।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কুরবানীর গোশতের তিন ভাগের এক ভাগ পরিবার-পরিজনকে দিতেন। আরেক ভাগ গরিব প্রতিবেশীদের দিতেন এবং এক ভাগ ভিক্ষুক ও অসহায়দের দান করতেন। Ñআল মুগনী ১৩/৩৭৯

উল্লেখ্য, এ বণ্টন উত্তম জরুরি বা আবশ্যক নয়। তেমনি একেবারে ওজন করে তিন ভাগ করাও আবশ্যক নয়। বরং কুরবানীকারীর জন্য এতে তারতম্য করার অবকাশ আছে।

আরো উল্লেখ্য যে, এটি যেহেতু একটি মুস্তাহাব আমল তাই সামর্থ্যবানদের এর উপর আমল করা উচিত। আর কারো পরিবারের সদস্য বেশি হলে কিংবা নিজেদের প্রয়োজন বেশি থাকলে সেক্ষেত্রে তারা নিজেদের প্রয়োজন পরিমাণ গোশত রাখতে পারবে, এটা তাদের জন্য অনুত্তম হবে না। যিলকদ ১৪৩৬ || সেপ্টেম্বর ২০১৫

কুরবানীর গোশত বণ্টনের প্রশ্নোক্ত পদ্ধতিটি আমাদের দেশের কোনো কোনো এলাকায় প্রচলিত একটি সমাজপ্রথা। সাধারণ দৃষ্টিতে এটি একটি ভালো উদ্যোগ মনে হতে পারে; কিন্তু কোনো সামাজিক প্রথা বা রীতি পালন করার জন্য তা শরীয়তের দৃষ্টিতে শুদ্ধ ও আমলযোগ্য কি না— তাও নিশ্চিত হতে হয়। ভালো নিয়ত থাকলেও শরীয়ত সমর্থন করে না অথবা ইসলামের নীতির সাথে মানানসই নয় এমন কোনো কাজ করা বা এমন কোনো রীতি অনুসরণ করার সুযোগ নেই।

প্রশ্নোক্ত সমাজপ্রথাটিতে উদ্দেশ্য ভালো হলেও যে পদ্ধতিতে তা করা হয় এতে শরীয়তের দৃষ্টিতে মৌলিক কিছু আপত্তি রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল, সামাজিক এ প্রথার কারণে সকলেই তার কুরবানীর এক তৃতীয়াংশ গোশত সমাজের লোকদের হাতে দিতে বাধ্য থাকে। এবং এর বিলি-বণ্টন ও গ্রহীতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে শুধু সমাজপতিদেরই হাত থাকে। গোশত বণ্টনের ক্ষেত্রে এ বাধ্যবাধকতা শরীয়তসম্মত নয়। কেননা শরীয়তে কুরবানী ও গোশত বণ্টন একান্তই কুরবানীদাতার নিজস্ব কাজ।

ঈদের দিন সম্মিলিতভাবে জামাতে নামায আদায় করতে বলা হলেও কুরবানীর জন্য কত মূল্যের পশু কিনবে, সে পশু কোথায় জবাই করবে, গোশত কীভাবে বণ্টন করবে—এ বিষয়গুলো কুরবানীদাতার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। শরীয়তে কুরবানীর কিছু গোশত সদকা করতে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং আত্মীয়-স্বজন ও গরীব-দুঃখীদের কুরবানীর গোশত দিতে তাকিদও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা কুরবানীদাতার উপর অপরিহার্য করা হয়নি। বরং কুরবানীদাতা কী পরিমাণ গোশত নিজে রাখবে, কী পরিমাণ সদকা করবে এবং কাকে কাকে বিলি করবে আর কী পরিমাণ আগামীর জন্য সংরক্ষণ করবে— এগুলো কুরবানীদাতার একান্তই নিজস্ব ব্যাপার এবং ব্যক্তিগতভাবে করার কাজ। এটিকে সামাজিক নিয়মে নিয়ে আসা ঠিক নয়।

তাই শরীয়তের মাসআলা জানা না থাকার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গোশত বণ্টনের প্রশ্নোক্ত যে পদ্ধতি প্রচলিত হয়েছে, তা পরিহারযোগ্য। নিম্নে সংক্ষেপে প্রশ্নোক্ত প্রথাটির কিছু ক্ষতির দিক উল্লেখ করা হল—

১. অনেক কুরবানীদাতার পরিবারের সদস্য-সংখ্যা বেশি হওয়ায় অথবা অন্য কোনো যৌক্তিক কারণে নিজ পরিবারের জন্য বেশি গোশত রাখার প্রয়োজন হয়; ফলে সে পরিবারের জন্য বেশি গোশত রাখতে চায়। আবার অনেকে তার কোনো দরিদ্র আত্মীয়কে কুরবানীর গোশত দিতে চায়। কিন্তু সামাজিক এই বাধ্যবাধকতার কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সামাজিক রীতি অনুযায়ী কুরবানীর এক তৃতীয়াংশ গোশত সমাজে দিতে বাধ্য হয়। অথচ হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন—

إِنَّهُ لَا يَحِلُّ مَالُ امْرِئٍ إِلَّا بِطِيبِ نَفْسٍ مِنْهُ.

কোনো মুসলমানের সম্পদ তার সন্তুষ্টি ব্যতীত হালাল নয়। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০৬৯৫)

২. প্রশ্নোক্ত প্রথায় গোশতদাতা তার দানের অংশটি কাকে দেবে সে স্বাধীনতা হারায়। হয়তো সে তার নিকটাত্মীয় অথবা পরিচিত কাউকে একটু বেশি পরিমাণে দিত, কিন্তু এক্ষেত্রে তার জন্য এমনটি করার সুযোগ থাকে না।

৩. অনেক মানুষ এমন আছেন, যারা প্রত্যেকের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে চান না। আর শরীয়তও কাউকে সকলের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে বাধ্য করেনি। কিন্তু সামাজিক এই রীতির কারণে গোশত গ্রহণকারী প্রত্যেকেই অন্য সকলের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বলাবাহুল্য এ ধরনের ঐচ্ছিক বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা মোটেই উচিত নয়।

৪. এ ধরনের বাধ্যবাধকতা আরোপের আরেকটি ক্ষতিকর দিক হল, সমাজের কিছু মানুষ এমন থাকে, যাদের আয় রোজগার হারাম পন্থায় হয়। সেক্ষেত্রে জেনে বুঝে তাদের কুরবানীর গোশত সমাজের সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়। অথচ হারাম উপার্জনের মাধ্যমে কুরবানীকৃত পশুর গোশত খাওয়া জায়েয নয়।

মোটকথা, শরীয়তের শিক্ষা মোতাবেক প্রত্যেককে তার কুরবানীর অংশ দান করার বিষয়ে স্বাধীন রাখতে হবে। প্রশ্নোক্ত পদ্ধতিতে বা অন্য কোনোভাবে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যাবে না। কুরবানীদাতা নিজ দায়িত্ব ও বিবেচনা মতো যাকে যে পরিমাণ হাদিয়া করতে চায় করবে এবং গরীব-মিসকীনকে যে পরিমাণ সদকা করতে চায় করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় থেকে শত শত বছর যাবৎ এ পদ্ধতিই চলমান আছে। এই পদ্ধতিই অবলম্বন করা জরুরি। শরীয়ত যা চালু করতে বলেনি এমন কোনো প্রথা চালু করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

—সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭২; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫১০; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪; তাবয়ীনুল হাকায়েক ৬/৪৮২; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪৭৩; আলবাহরুর রায়েক ৮/১৭৮; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০০; রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৮

Share Copy Link

মন্তব্য

সকল প্রসঙ্গ

২৭তম রজনী
অনলাইন কোর্স
অলিম্পিক
আংটি
আধুনিক মাসআলা
আধুনিক মাসাআলা
আমল
উম্মুল মু'মিনিন
ঋণ
ওকালতি
কট
কাপড়ের মোজা
কাফফারা
কাযা
কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস
কুফর
কুরবানী
ক্রিকেট
ক্রিপ্টোকারেন্সি
ক্র্যাকড
খেলাধুলা
খেলাধুলা হতে উপার্জন
গোশত বন্টনে
জমি
জর্দা
ডাক্তারি বিদ্যা
ডিফেন্স ফোর্স
ড্রপ শিপিং
তাকবীরে তাহরিমা
তামাক
তারাবীহ
তালাক
দাবা
দৈনন্দিন আমল
দোআ
দোয়া
নবীজি
নবুয়তের সিলমোহর
নামাজ
নেশা
নৌবাহিনী
পাইরেটেড
পার্লামেন্ট সদস্য
পাশা
পুলিশ
পেইড কোর্স
প্রয়োজনীয়
ফরেক্স ট্রেডিং
ফিদিয়া
ফুটবল
বন্ধক
বর্গা
বাইনারি ট্রেডিং
বিচারপতি
বিটকয়েন
বিড়ি
বিডিআর
ব্যবসায়
ব্যাডমিন্টন
ব্যারিস্টার
মদ
মাকরুহ
মাসবুক
মাসেহ
মুনাজাত
মেডিকেল
মোজা
যাকাত
যাকাত-ফিতরা
রাজনীতি
রাস্তায় পাওয়া জিনিস
রুকু
রোজা
রোজা ভঙ্গের কারণ
রোজার মাসআলা
রোজার মাসাআলা
রোযা ভঙ্গের কারণ
র‍্যাব
লাইলাতুল ক্বদর
লাইলাতুল বারাআত
লুডু
শতরঞ্জ
শবে ক্বদর
শবে বরাত
শিক্ষক
সফটওয়্যার
সংবিধান
সরকারি চাকরি
সহশিক্ষা
সাধারণ সরকারি চাকরি
সামরিক বাহিনী
সামাজিক প্রথা
সালাম
সিগারেট
সিজদা
সুদ
সেক্যুলারিজম
সেনাবাহিনী
স্ত্রী
হারাম

© ২০২৫ শরয়ী সমাধান - সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

Facebook Group