সাধারণ চাকুরিঃ খাদ্য মন্ত্রনালয়, বস্ত্র, পাট, ইত্যাদি তথা মন্ত্রনালয়ের যেসব পদগুলো সংবিধান - আইন প্রনয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় অনুরুপভাবে ডাক্তারি, শিক্ষকতা, ট্রাফিক পুলিশ, ঔষধ কোম্পানির চাকুরি, হসপিটালে ইত্যাদি। আমাদের সর্বশেষ আলোচ্য বিষয় হলো সাধারণ সরকারি চাকুরি। অর্থাৎ যেই চাকুরিগুলা পূর্বে অতিবাহিত হওয়া ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত নয় তথা রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান প্রণয়ন, কুফর প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করা, খুন লুটপাটের সঙ্গে যেগুলা সম্পৃক্ত নয়ঃ এমন সরকারি চাকুরি নিয়েই মূলত আলোচনা হবে।
আমরা আগেই বলেছি যেঃ সরকারি চাকরিসমূহ তিন ভাগে বিভক্তঃ
১. এমন চাকরি যেখানে সরকারের কুফরি কাজে অংশগ্রহণ বা সহযোগিতা করতে হয়। এ ধরনের চাকরি করা কুফরি, যা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
২. এমন চাকরি যেখানে কুফরি কাজ না করা লাগলেও হারাম কাজে অংশগ্রহণ বা সহযোগিতা করতে হয়, এমন চাকরি করা হারাম।
৩. এমন চাকরি যেখানে কুফরি এবং হারাম কোনো কাজই করতে হয় না বরং কাজটি মৌলিকভাবে জায়েয। তাগুত সরকারের অধীনে এমন চাকরি থেকেও যথাসম্ভব বিরত থাকাই উত্তম; যদিও চাকরির কারণে কোনো নাজায়েয কাজ করতে না হয়।
এসমস্ত সরকারি চাকুরিতে যোগদান করতে শরীয়তে মৌলিকভাবে বাধা নাই। এই চাকুরিগুলো সত্তাগতভাবে জায়েজ। ডাক্তারি করা, ঔষধ বিক্রি করা, ইমামতি করা; এসব কাজই ভালো কাজ সত্তাগত বিবেচনায়। কেউ যদি অসদুপায় অবলম্বন না করে হালালভাবে কাজগুলো করে তাহলে সেটা জায়েজ। তবে এই কাজগুলো অনৈসলামিক রাষ্ট্রে অথবা তাগুত সরকারের অধীনে না করে পারা গেলে সেটাই উত্তম। যথা সম্ভব সরকারের সম্পৃক্ততা থেকে বিরত থাকা উত্তম। তাছাড়া এসব সরকারি কাজের বেতনের বেশিরভাগই দেয়া হয় প্রজাদের থেকে জুলুম করে আদায় করা ট্যাক্স থেকে।
আল্লামা আইনি রাহিমাহুল্লাহ বলেছেনঃ বর্তমান যমানায় ট্যাক্স হল, জালেমরা যা নগর-বন্দরে আগমনকারী ব্যবসায়ী এবং বাজারে ক্রয়-বিক্রয়কারীদের থেকে উত্তোলন করে। ইসলামপূর্ব সময়ে এই ট্যাক্সের প্রচলন ছিল। ইসলাম তা বাতিল করে দেয় এবং শরয়ী বিধান অনুযায়ী যাকাত, উশর ও খারাজ আদায়ের নির্দেশ দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে যখন জালেম শাসকরা ক্ষমতা দখল করে, তারা পুনরায় এ জুলুম শুরু করে।
তারপর থেকেই জালেম ও ফাসেক মন্ত্রীরা এ ট্যাক্সের পরিমাণ নির্ধারণ করতে থাকে, তা বাড়াতে থাকে এবং তার অনেক শাখা প্রশাখা বের করতে থাকে। এমনকি পরিশেষে তারা ছোট-বড় সব কিছুতেই ট্যাক্স আরোপ করে। আর এর মাধ্যমে তারা নবীজির এ বাণীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, ‘যে আমাদের দ্বীনের মাঝে নতুন কোনো বিষয় উদ্ভাবন করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (1) আমাদের শরীয়তে ট্যাক্স হারাম সম্পূর্ণ। ট্যাক্স গ্রহণ করে তাই জালেমের সহযোগী হওয়া যাবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
لا يدخُل الجنةَ صاحبُ مَكْسٍ”. رواه أبو داود (2937)
“ট্যাক্স গ্রহণকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” -সুনানে আবু দাউদ :2937)
এইজন্য এসমস্ত সরকারিভাবে চাকুরি থেকে বেঁচে থাকা উত্তম।
তাগুতের অধীনে জায়েয কাজেও চাকরী না করা উত্তম, যদিও তাতে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক না থাকে। তাতে তাগুত বর্জন ও তাগুতের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ পূর্ণাঙ্গ হয়। আর যদি তা তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসাসহ হয়, বা অনিবার্যভাবে তা তাদের বন্ধুত্বের দিকে নিয়ে যায়, তাহলে তা সম্পূর্ণই নাজায়েয। (2)
বাহ্যদৃষ্টিতে এই ধরনের চাকরির ক্ষেত্রে তো কোনো সমস্যা চোখে পড়ে না। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ করলে বোঝা যায়, এর দ্বারাও তাগুতি শাসনব্যবস্থার একধরনের সহযোগিতা হয়। হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলি থানবি রহ.-এর চিন্তাধারার সবচে নির্ভরযোগ্য ভাষ্যকার মাওলানা আবদুল বারি নদবি রহ. বলেনঃ তবে চাকরির ক্ষেত্রে অন্ততপক্ষে এতটুকু সতর্কতার নির্দেশনা রয়েছে যে, যদি জীবনযাপনের অন্য কোনো সুযোগ না থাকে, তাহলে (অপারগ হয়ে) শিক্ষা এবং এজাতীয় অন্যান্য ক্ষেত্র; যেগুলোতে আদালত ও এজাতীয় অন্যান্য দায়িত্বের পদগুলোর মতো স্পষ্টভাবে শরিয়াহর বিধিবিধানের বিরুদ্ধাচারণ করতে হয় না; বেছে নিয়ে এগুলোতে চাকরি করো। (3)
এইজন্য শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ. কাফির শাসকের অধীনে কাপড় সেলাই করা অথবা পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করে দেওয়ার ব্যাপারে বলেন, এগুলো যদিও বাহ্যিকভাবে বৈধ; কিন্তু গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে প্রতিভাত হয়, এগুলো কোনোটাই হারাম থেকে মুক্ত নয়। অর্থাৎ এগুলো ধীরে ধীরে মানুষকে জুলুম, অন্যায়ের দিকে ধাবিত করে। এ প্রসঙ্গে তিনি তার ফাতওয়ার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, কারণগুলোও বিশ্লেষণসহকারে তুলে ধরেছেন। (4)
যেখানে একজন মুসলমানের জন্য অপরিহার্য হলো তাগুতকে উৎখাত করা, সেখানে তাদের মদদ করা তো কোনো মুসলমানের কাজ হতে পারে না। মুসলমানদের মাথার ওপর জোরপূর্বক চেপে থাকা এসকল তাগুত নব্য ক্রুসেডার কুফফার গোষ্ঠীর তাবেদার পুতুল ছাড়া কিছু নয়। ঈমানের পরে মুসলিম উম্মাহর ওপর এসকল আগ্রাসী শত্রুকে প্রতিহত করার চাইতে বড় কোনো আবশ্যকীয় বিষয় নেই। (5)
তবে মুলকথা হলোঃ এইসমস্ত পদে চাকুরি করে তার পারিশ্রমিক বা বেতন বৈধ আছে। তবে শর্ত হলো কোন হারাম কাজে সহযোগিতা বা অন্যায় কাজে সমর্থন জানানো যাবে না। অন্যায়ভাবে উপার্জন করা যাবে না। বেপর্দায় থাকা যাবে না। যদি কেউ জুলুম করে, ফাঁকি দেয় কাজে, অতিরিক্ত দাম রাখে, বেপর্দায় থাকে, ফ্রি মিক্সিংয়ে চলে; তাহলে এইভাবে তাদের জন্য বেতন হালাল হলেও তাদের গুনাহের উপর অটল থেকে কাজ করা অবৈধ। (6)
যেমনটা বলেছেন মাওলানা আবদুল হাই ফিরিঙ্গি মহল্লি রহ. বৈধ চাকরি ও অবৈধ চাকরির পরিচয় প্রসঙ্গে লেখেনঃ
جس نوکری میں اجراۓ احکام غیر شرعیہ کی اور اجراۓ احکام ظلم وغیرہ کی نہ ہو وہ درست ہے اور جن میں یہ امور ہوں وہ حرام ہے۔
যে চাকরিতে শরিয়াহবহির্ভূত বিধিবিধান বাস্তবায়ন এবং জুলুম ও এজাতীয় অন্যান্য বিষয়ের বিধিবিধান প্রয়োগ করতে হয়, তা নাজায়িয। আর যে চাকরিতে এই সমস্যাগুলো থাকবে না, তা জায়িয। (7)
রেফারেন্সঃ
(1) المكس في هذا الزمان: ما يأخذه الظلمة والأعوان من التجار الواردين في البلاد ومن الباعة والشراة في الأسواق بأشياء مقررة عليهم على طريق الظلم والعدوان، وكان هذا قبل الإِسلام في الجاهلية، ثم لما جاء الشرع أبطل هذا وأمرهم أن يؤدوا الزكوات والعشور والخراج على الأوضاع الشرعية، ثم لما استولت الظلمة من الملوك والخونة من الحكام أعادوا هذا الظلم، ثم لم يزل الوزراء الظلمة الفسقة يحددون ذلك ويزيدون عليه ويفرعون تفريعات حتى وضعوه في كل شيء جليل وحقير، ودخلوا تحت قوله – عليه السلام -: “من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فليس منا”. (نخب الأفكار 8/ 113)
(2) لَّا یَتَّخِذِ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلۡكَـٰفِرِینَ أَوۡلِیَاۤءَ مِن دُونِ ٱلۡمُؤۡمِنِینَۖ وَمَن یَفۡعَلۡ ذَ ٰلِكَ فَلَیۡسَ مِنَ ٱللَّهِ فِی شَیۡءٍ إِلَّاۤ أَن تَتَّقُوا۟ مِنۡهُمۡ تُقَىٰةࣰۗ وَیُحَذِّرُكُمُ ٱللَّهُ نَفۡسَهُۥۗ وَإِلَى ٱللَّهِ ٱلۡمَصِیرُ ( سورة ال عمران: ٢٨)
(3)
البتہ نوکریوں میں کم از کم اتنی احتیاط کی ھدایت ہے کہ اگر کوئئ اور صورت معاش کا نھیں تو تعلیمات وغیرہ کی ویسی نوکریاں کرو جن میں عدالتی عہدوں وغیرہ کی طرح شریعت کے احکام کی صراحتًا مخالفت نہ کرنا پڑے.
( মাসিক মাআরিফ, জানুয়ারি, ১৯৪৭)
(4) ফতোয়া আজিযি: ৪১৬ পৃষ্ঠা
(5) عن ابي بكر قال: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ : " مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيمَانِ " ( صحيح البخاري: 49) قال القاضي عياض رحمه الله : هذا الحديث أصل في صفة التغيير ، فحق المغير أن يغيره بكل وجه أمكنه زواله به قولا كان أو فعلا ؛ فيكسر آلات الباطل ، ويريق المسكر بنفسه ، أو يأمر من يفعله ، وينزع الغصوب ويردها إلى أصحابها بنفسه ، أو بأمره إذا أمكنه ويرفق في التغيير جهده بالجاهل وبذي العزة الظالم المخوف شره ؛ إذ ذلك أدعى إلى قبول قوله . كما يستحب أن يكون متولي ذلك من أهل الصلاح والفضل لهذا المعنى . ويغلظ على المتمادي في غيه ، والمسرف في بطالته ؛ إذا أمن أن يؤثر إغلاظه منكرا أشد مما غيره لكون جانبه محميا عن سطوة الظالم . فإن غلب على ظنه أن تغييره بيده يسبب منكرا أشد منه من قتله أو قتل غيره بسبب كف يده ، واقتصر على القول باللسان والوعظ والتخويف . فإن خاف أن يسبب قوله مثل ذلك غير بقلبه ، وكان في سعة ، وهذا هو المراد بالحديث إن شاء الله تعالى (فتح الباري: ١٢/٢)
(6) وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلا تَعَاوَنُوا عَلَى الإثْمِ وَالْعُدْوَانِ ) يأمر تعالى عباده المؤمنين بالمعاونة على فعل الخيرات ، وهو البر ، وترك المنكرات ، وهو التقوى ، وينهاهم عن التناصر على الباطل ، والتعاون على المآثم ، والمحارم .
"( تفسير ابن كثير :2 / 12-13)
(7) وفي فتوى اهل سمرقند: اذا استاجر رجلا ينحت له طنبورا او بربطا ففعل يطيب له الاجر الا انه ياثم في الاعانة على المعصية وانما وجب له الاجر في هذه المسائل.( المحيط البرهاني: 446/11, البحر الرائق: 36/8)
وعن محمد: رجل استاجر رجلا لصور له صورا او تماثيل الرجال في بيت او فسطاط فاني اكره ذلك واجعل له الاجر : (هندية: كتاب الاجارة: 450/4،قديم ، الفتاوي التاتارخانية: 130/15)
আল্লাহ আমাদেরকে বোঝার ও আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
সমাপ্ত।