চতুর্থ বিষয়ঃ অবশ্য কেউ কেউ বলার চেস্টা করেন যে, বিটকয়েন যদিও সরাসরি টাকা নয় কিন্তু বিটকয়েন টোকেন হিসেবে তো ব্যবহার হতে পারে। আমাদের দেশে টাকা কিন্তু দুই রকম আছে, একটা সরকারি নোট, একটা ব্যাংক নোট। আমাদের ১০০০ বা ৫০০ টাকার যেসব নোট দেখি এগুলো কিন্তু মূল টাকা না, সরকারি টাকাও না। মুল টাকাগুলোর মধ্যে বাহককে... লেখাটা থাকে না। এবং এই নোটগুলোর কিন্তু বাস্তব কোন ভ্যালু নাই, যে কারণে সরকার ইচ্ছামতন প্রতি বছর টাকা ছাপাচ্ছে আর মুদ্রাস্ফীতি বাড়াচ্ছে।
এর জবাব আগেই গিয়েছে। কোন মুদ্রা যথাযথভাবে মুদ্রার হওয়ার জন্য দুটি শর্ত একেবারে জরুরি। (১) রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং তার ব্যাবহারযোগ্য হওয়া। (২) জনগণ মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করা। ৫০০/১০০০ টাকা বাংলাদেশের এগুলোর সরকারি স্বীকৃতি এবং ব্যাবহারযোগ্যতা তো আছেই, সঙ্গে জনগনের গ্রহণ করাটাও আছে। অর্থাৎ কোন বস্তু মুদ্রা কিংবা মূল্যমান হওয়ার জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় কিংবা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও ভ্যালু থাকতে হবে। যেমন আমাদের দেশের একশ টাকায় ‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে একশ টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে’ এ বাক্য লেখার মাধ্যমে স্বীকৃতি দেয়া আছে। এখন রাষ্ট্র কর্তৃক এ স্বীকৃতি বিলুপ্ত করলে তা মূল্যমান হারিয়ে কেবল একটি কাগজের টুকরায় পরিণত হবে। কাউকে ফ্রি দিলেও নিতে চাইবে না। ‘চাহিবামাত্র...’ এ বাক্যটিই রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি।
বিটকয়েন টোকেন হিসেবেও জায়েজ হবে না। এর কারণ একাধিকঃ
এর প্রচলণকারী কারা জানা নাই, অজ্ঞাত। পরিচালনা কমিটি নাই।
এটির কোন বাস্তবিক অস্তিত্ব নেই, স্রেফ স্ক্রিন ভিউ।
এটি সবার কাছে সহজলভ্য না, ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
সরকারিভাবে এগুলোর কোন প্রচারণা নেই, বৈধতাও নেই।
সর্বশেষ এটি টোকেন হলেও এর প্রকাশকের অজ্ঞতা, এর ভবিষ্যৎ বিষয়ে অজ্ঞতা, এর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রকাশক না থাকা, কোনো নির্দিষ্ট দায়িত্বশীল না থাকা, রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণ না থাকা, ব্যাপকভাবে স্প্যাকুলেশন হওয়ায় এর মূল্য স্থির না থাকা এবং আইনবহির্ভূত কাজে অধিক ব্যবহৃত হওয়ায় এটি ইসলামের দৃষ্টিতে মূল্যমানবিশিষ্ট (মালে মুতাকাওয়্যিম) হয় না; সঙ্গে জুয়া তো আছেই।
তাই উসুলে শরীআহ মতে এটি মুল্যমানই রাখবে না ধোঁকা প্রতারণার সমুহ সম্ভাবনার কারণে।
কিছু কিছু ভাই বলেন - হাতে মাল না থাকার কারনে যে লেনদেন নিষিদ্ধ হয়, এই সুত্রে সফটওয়্যার, পিডিএফ বই, অনলাইন কোর্স কেনাবেচাও নিষিদ্ধ হওয়ার কথা। কারন বাস্তবে এটা কবজ করা যায় না। অনুরুপভাবে
এখন কিছু দেশের সরকার বিটকয়েনের লেনদেন অনুমোদন দিয়েছে। তাহলে বিটকয়েনের হুকুম সেখানে কি হবে? তাছাড়া গতকয়েক বছরে বাংলাদেশের টাকার তুলনায় বিটকয়েনের রেট কম অস্থির ছিল। তাই এটি জায়েজ হওয়ার কথা!
উপরের সবকিছুই স্রেফ যুক্তি। শরয়ী উসুলের আলোকে তা টিকবে না। কিন্তু শরীয়ত এখানেও কথা বলেছে। এগুলোকে বই, পিডিএফ এর সত্ত্বাধিকারীর বিষয়টি শরীয়তে بيع الحقوق، حقوق الطبع، ইত্যাদি পরিভাষায় নামকরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ নিজেদের কোন পণ্যের সত্ত্বাধিকারী বিক্রয় করা, যেমন প্রকাশনা সত্ত্বাধিকারী, কোর্সের সত্ত্বাধিকারী ইত্যাদি বিক্রি করা। এগুলা জায়েজ। কারণ বর্তমানে এগুলা পণ্যের স্থানে। এব্যাপারে বুহুস ফি ক্বযায়া মুআসিরাহ এবং ফিক্বহুল বুয়ু আল্লামা মুফতি তাক্বি উসমানি সাহেব আলোচনা করেছেন।
এসব সফটওয়্যার, পিডিএফ এগুলো বর্তমানে মালে মুতাক্বাওওয়িম তথা মুল্যমান বলেছেন, সমস্ত ফুক্বাহায়ে কেরাম বলেছেন। তাই বিক্রিতে সমস্যা নাই। আর কিছু কিছু রাষ্ট্র যদিও বৈধতা দেয়, কিন্তু সেটি মুল্যমান হতে হলে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা দরকার, নতুবা কিছু দেশে চালু হলেই তা মুল্যমান স্বীকৃতি লাভ করে না। এবং তা ধোঁকা, প্রতারণা মুক্ত থাকতে হবে, প্রকাশকের অজ্ঞতাই বড় রিস্কের কারণ!
আর এ কথা সঠিক যে টাকার তুলনায় গত একবছর বিটকয়েনের রেট কম আপডাউন করেছিলো। কিন্তু বিটকয়েনের রেট আপডাউনের অবস্থা সবসময়ই ভয়াবহ। এর অস্তিত্ব না থাকার কারণে এখানে বিনিয়োগ পুরাটাই জুয়া।
পঞ্চম বিষয়ঃ বিটকয়েন তথা ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যাপারে বিশ্বের গ্রহণযোগ্য ফতোয়া বিভাগগুলো যেমন বিশ্ববিখ্যাত দ্বীনি বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দ, পাকিস্তানের জামিয়া বানুরি টাউন, মিশরের দারুল ইফতাসহ অসংখ্য মুফতি উলামায়ে কেরাম এটাকে নাজায়েজ বলেছেন।
"তেজারত কা মাসায়েল কা এনাসাইক্লোপিডিয়া" এর দ্বিতীয় খণ্ডের ৯২ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে :
آج کل عالمی مارکیٹ میں ایک کوئن رائج ہے جسے ’’بٹ کوئن‘‘ یا ’’ڈیجیٹل کرنسی‘‘ کہتے ہیں،یہ ایک محض فرضی کرنسی ہے، اس میں حقیقی کرنسی کے بنیادی اوصاف اور شرائط بالکل موجود نہیں ہیں،لہٰذا موجودہ زمانہ میں ’’کوئن‘‘ یا ’’ ڈیجیٹل کرنسی‘‘ کی خرید وفروخت کے نام سے انٹر نیٹ پر اور الیکٹرونک مارکیٹ میں جو کاروبار چل رہا ہے، وہ حلال اور جائز نہیں ہے، وہ محض دھوکہ ہے، اس میں حقیقت میں کوئی مبیع وغیرہ مادی چیز نہیں ہوتی ، اور اس میں قبضہ بھی نہیں ہوتا، صرف اکاؤنٹ میں کچھ عدد آجاتے ہیں، اور یہ فاریکس ٹریڈنگ کی طرح سود اور جوے کی ایک شکل ہے؛ اس لیے ’’بٹ کوئن‘‘ یا کسی بھی ’’ڈیجیٹل کرنسی‘‘ کے نام سے نہاد کاروبار میں پیسے لگانا اور خرید وفروخت میں شامل ہونا جائز نہیں ہے۔ ‘‘(ص:٩٢،ج:٢،حرف باء،بٹ کوئن،ط:بیت العمار،کراچی)
"বর্তমানে বিশ্ববাজারে একটি মুদ্রা প্রচলিত রয়েছে, যাকে ‘বিটকয়েন’ বা ‘ডিজিটাল কারেন্সি’ বলা হয়। এটি এক প্রকার কাল্পনিক মুদ্রা, যার মধ্যে বাস্তব মুদ্রার প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য ও শর্ত নেই। এ কারণে বর্তমানে ‘কয়েন’ বা ‘ডিজিটাল কারেন্সি’ নামে ইন্টারনেট ও ইলেকট্রনিক বাজারে যে ব্যবসা চলছে, তা বৈধ নয়। এটি আসলে প্রতারণার শামিল, কারণ এতে কোনো প্রকৃত বস্তুর অস্তিত্ব নেই, এবং হস্তান্তরও সম্ভব হয় না, কেবল অ্যাকাউন্টে কিছু সংখ্যা যুক্ত হয়, যা মূলত ফরেক্স ট্রেডিংয়ের মতো সুদ ও জুয়ার এক ধরণ। তাই ‘বিটকয়েন’ বা যেকোনো ‘ডিজিটাল কারেন্সি’তে বিনিয়োগ করা বা কেনাবেচায় অংশগ্রহণ করা বৈধ নয়।" (পৃষ্ঠা: ৯২, খণ্ড: ২) দারুল উলুম দেওবন্দের কাছে বিটকয়েন সম্পর্কে জানতে চাইলে লম্বা ফতোয়া প্রকাশ করেছে। বিস্তারিত বলেছে।
দারুল উলুম দেওবন্দের ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছেঃ "বিটকয়েন বা অন্য কোনও ডিজিটাল মুদ্রা একটি কেবল কল্পনাপ্রসূত মুদ্রা। এর মধ্যে প্রকৃত মুদ্রার মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি নেই। বর্তমানে বটকয়েন বা ডিজিটাল মুদ্রার কেনাবেচার নামে যে ব্যবসা চলছে, তা আসলে একটি প্রতারণা; এর মধ্যে বাস্তবিকভাবে কোনও পণ্য বা বস্তু নেই এবং এই ব্যবসায়ে বেচাকেনার বৈধতার শারীয় শর্তগুলি পাওয়া যায় না। বরং এটি বাস্তবে ফরেক্স ট্রেডিংয়ের মতো সুদ এবং জুয়ার রূপ। সুতরাং, বিটকয়েন বা অন্য কোনও ডিজিটাল মুদ্রার কেনাবেচার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটে চলমান এই ব্যবসা শরিয়া অনুযায়ী বৈধ নয়। অতএব, বিটকয়েন বা অন্য কোনও ডিজিটাল মুদ্রার নামের এই ব্যবসায়ে অংশগ্রহণ করা বা অন্য কাউকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে দেওয়া উচিত নয়।
আজকাল বিশ্বের বিভিন্ন মুদ্রাগুলি প্রকৃতপক্ষে সম্পদ নয়; এগুলি কেবল কাগজের টুকরা। এগুলোর মধ্যে যে মূল্য বা পরিচিত মূল্য আছে, তা দুই কারণে হয়; প্রথমত, এর পেছনে দেশের অর্থনৈতিক উপাদান থাকে; এ কারণে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও অবনতি মুদ্রার মূল্যকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ, অর্থনীতির কারণেই দেশের মুদ্রার মূল্য বাড়ে এবং কমে। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি দেশ জনগণের জন্য তাদের মুদ্রার জন্য একটি গ্যারান্টি এবং দায়িত্বশীল থাকে; এ কারণেই যখন একটি দেশ তাদের কোনো মুদ্রা বন্ধ করে, তখন মুদ্রাটি কেবল কাগজের নোট হয়ে যায় এবং এর কোনো মূল্য বা মর্যাদা থাকে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ডিজিটাল মুদ্রার পেছনে কী আছে যার কারণে এর মূল্য নির্ধারিত হয় এবং এর উন্নতি ও অবনতি থেকে মুদ্রার মূল্য বাড়ে এবং কমে? সেই সঙ্গে, এই মুদ্রার গ্যারান্টি ও দায়িত্ব কে? এবং মুদ্রার পেছনে যে কিছু থাকে, তা কি সত্যিকার অর্থে গ্যারান্টির নিয়ন্ত্রণে আছে, নাকি এটি কেবল কাল্পনিক ও প্রতীকী?
ডিজিটাল মুদ্রা সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখাগুলি পড়ার পর এবং এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করার পর, জানা গেল যে ডিজিটাল মুদ্রা কেবল একটি কাল্পনিক বিষয়। এর শিরোনাম হাতির দাঁতের মতো, যা কেবল দেখানোর জন্য; এবং বাস্তবে এটি ফরেক্স ট্রেডিংয়ের মতো ইন্টারনেটে চলমান জুয়া ও সুদের ব্যবসার একটি রূপ। এতে প্রকৃতপক্ষে কোনো ক্রিয়াকলাপ বা পণ্য নেই এবং এই ব্যবসায় বাণিজ্যের বৈধতা সম্পর্কিত শরীয়তের শর্তাবলিও নেই।
সুতরাং সংক্ষেপে বলা যায় যে, বিটকয়েন বা অন্য কোনো ডিজিটাল মুদ্রা কেবল একটি কাল্পনিক মুদ্রা, এটি বাস্তব এবং প্রকৃত মুদ্রা নয়। এছাড়া কোনো ডিজিটাল মুদ্রায় বাস্তব মুদ্রার মৌলিক গুণাবলী নেই। ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবসায় জুয়া ও সুদের উপাদান স্পষ্টভাবে দেখা যায়; তাই বিটকয়েন বা অন্য কোনো ডিজিটাল মুদ্রার কেনাবেচা বৈধ নয়। একইভাবে, বিটকয়েন বা অন্য কোনো ডিজিটাল মুদ্রার বাণিজ্যও ফরেক্স ট্রেডিংয়ের মতো অবৈধ; সুতরাং এই ব্যবসা থেকে বিরত থাকা উচিত। বাস্তবে এটি ফরেক্স ট্রেডিং ইত্যাদির মতো ইন্টারনেটে চলমান জুয়া ও সুদের ব্যবসার একটি রূপ। এতে প্রকৃতপক্ষে কোনো পণ্য বা সম্পদ নেই এবং এর ব্যবসায় বাণিজ্যের বৈধতা সম্পর্কিত শরীয়তের শর্তাবলিও নেই।
সুতরাং, যদি প্রকৃতপক্ষে এটি এমনটাই হয় (যেমন প্রকাশ্যে বোঝা যাচ্ছে), তাহলে নির্দেশ হবে যে ডিজিটাল মুদ্রায় টাকা লগ্নি করা বা এর জন্য কাউকে কোম্পানির সদস্য হিসেবে যুক্ত করা বৈধ নয়; কারণ ইসলামিতে জুয়া এবং সুদের ব্যবসা সম্পূর্ণরূপে হারাম ও অবৈধ। তবে, যদি এই মুদ্রা সত্যিকার অর্থে একটি মুদ্রা হয়ে যায়, কেবল ডিজিটাল না থাকে এবং এর প্রকৃতি সম্পূর্ণভাবে প্রকৃত মুদ্রার মতো হয়ে যায়, তবে এর নিয়ম সাধারণ মুদ্রার মতো হবে।" (১)
তবে বিটকয়েনের লেনদেন জায়েজ হতে হলে কিছু শর্ত আছেঃ
রাষ্ট্রীয়ভাবে মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃত হতে হবে।
জনসাধারন এই লেনদেনের ধোঁকা, প্রতারণা থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ হতে হবে। সহজলভ্য হতে হবে।
রেট অস্বাভাবিক রকমের আপডাউন হতে পারবে না, স্থিতিশীল হতে হবে।
এর প্রকাশক অজ্ঞাত হতে পারবে না।
উপরোক্ত শর্তগুলি পরিপূর্ণ পেতে হবে।
সবকিছু পর্যালোচনার পরে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যেঃ বিটকয়েন তথা ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং এজাতীয় ডিজিটাল কয়েনের লেনদেন মৌলিকভাবে জায়েজ নাই। তবে উপরোক্ত শর্তগুলি পূর্ণাঙ্গভাবে পাওয়া গেলে এটিকে মুদ্রা বলে গন্য করা হবে এবং শরয়ী নীতিমালা অনুযায়ি লেনদেন বৈধ হবে।