Logoশরয়ী সমাধান
Cover image

প্রবন্ধ

বিটকয়েনের শরয়ী পর্যালোচনাঃ চতুর্থ (শেষ) পর্ব

Hm Sulayman

১৬ এপ্রিল, ২০২৫

চতুর্থ বিষয়ঃ অবশ্য কেউ কেউ বলার চেস্টা করেন যে, বিটকয়েন যদিও সরাসরি টাকা নয় কিন্তু বিটকয়েন টোকেন হিসেবে তো ব্যবহার হতে পারে। আমাদের দেশে টাকা কিন্তু দুই রকম আছে, একটা সরকারি নোট, একটা ব্যাংক নোট। আমাদের ১০০০ বা ৫০০ টাকার যেসব নোট দেখি এগুলো কিন্তু মূল টাকা না, সরকারি টাকাও না। মুল টাকাগুলোর মধ্যে বাহককে... লেখাটা থাকে না। এবং এই নোটগুলোর কিন্তু বাস্তব কোন ভ্যালু নাই, যে কারণে সরকার ইচ্ছামতন প্রতি বছর টাকা ছাপাচ্ছে আর মুদ্রাস্ফীতি বাড়াচ্ছে। এর জবাব আগেই গিয়েছে। কোন মুদ্রা যথাযথভাবে মুদ্রার হওয়ার জন্য দুটি শর্ত একেবারে জরুরি। (১) রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং তার ব্যাবহারযোগ্য হওয়া। (২) জনগণ মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করা। ৫০০/১০০০ টাকা বাংলাদেশের এগুলোর সরকারি স্বীকৃতি এবং ব্যাবহারযোগ্যতা তো আছেই, সঙ্গে জনগনের গ্রহণ করাটাও আছে। অর্থাৎ কোন বস্তু মুদ্রা কিংবা মূল্যমান হওয়ার জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় কিংবা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও ভ্যালু থাকতে হবে। যেমন আমাদের দেশের একশ টাকায় ‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে একশ টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে’ এ বাক্য লেখার মাধ্যমে স্বীকৃতি দেয়া আছে। এখন রাষ্ট্র কর্তৃক এ স্বীকৃতি বিলুপ্ত করলে তা মূল্যমান হারিয়ে কেবল একটি কাগজের টুকরায় পরিণত হবে। কাউকে ফ্রি দিলেও নিতে চাইবে না। ‘চাহিবামাত্র...’ এ বাক্যটিই রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি। বিটকয়েন টোকেন হিসেবেও জায়েজ হবে না। এর কারণ একাধিকঃ এর প্রচলণকারী কারা জানা নাই, অজ্ঞাত। পরিচালনা কমিটি নাই। এটির কোন বাস্তবিক অস্তিত্ব নেই, স্রেফ স্ক্রিন ভিউ। এটি সবার কাছে সহজলভ্য না, ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারিভাবে এগুলোর কোন প্রচারণা নেই, বৈধতাও নেই। সর্বশেষ এটি টোকেন হলেও এর প্রকাশকের অজ্ঞতা, এর ভবিষ্যৎ বিষয়ে অজ্ঞতা, এর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রকাশক না থাকা, কোনো নির্দিষ্ট দায়িত্বশীল না থাকা, রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণ না থাকা, ব্যাপকভাবে স্প্যাকুলেশন হওয়ায় এর মূল্য স্থির না থাকা এবং আইনবহির্ভূত কাজে অধিক ব্যবহৃত হওয়ায় এটি ইসলামের দৃষ্টিতে মূল্যমানবিশিষ্ট (মালে মুতাকাওয়্যিম) হয় না; সঙ্গে জুয়া তো আছেই। তাই উসুলে শরীআহ মতে এটি মুল্যমানই রাখবে না ধোঁকা প্রতারণার সমুহ সম্ভাবনার কারণে। কিছু কিছু ভাই বলেন - হাতে মাল না থাকার কারনে যে লেনদেন নিষিদ্ধ হয়, এই সুত্রে সফটওয়্যার, পিডিএফ বই, অনলাইন কোর্স কেনাবেচাও নিষিদ্ধ হওয়ার কথা। কারন বাস্তবে এটা কবজ করা যায় না। অনুরুপভাবে এখন কিছু দেশের সরকার বিটকয়েনের লেনদেন অনুমোদন দিয়েছে। তাহলে বিটকয়েনের হুকুম সেখানে কি হবে? তাছাড়া গতকয়েক বছরে বাংলাদেশের টাকার তুলনায় বিটকয়েনের রেট কম অস্থির ছিল। তাই এটি জায়েজ হওয়ার কথা! উপরের সবকিছুই স্রেফ যুক্তি। শরয়ী উসুলের আলোকে তা টিকবে না। কিন্তু শরীয়ত এখানেও কথা বলেছে। এগুলোকে বই, পিডিএফ এর সত্ত্বাধিকারীর বিষয়টি শরীয়তে بيع الحقوق، حقوق الطبع، ইত্যাদি পরিভাষায় নামকরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ নিজেদের কোন পণ্যের সত্ত্বাধিকারী বিক্রয় করা, যেমন প্রকাশনা সত্ত্বাধিকারী, কোর্সের সত্ত্বাধিকারী ইত্যাদি বিক্রি করা। এগুলা জায়েজ। কারণ বর্তমানে এগুলা পণ্যের স্থানে। এব্যাপারে বুহুস ফি ক্বযায়া মুআসিরাহ এবং ফিক্বহুল বুয়ু আল্লামা মুফতি তাক্বি উসমানি সাহেব আলোচনা করেছেন। এসব সফটওয়্যার, পিডিএফ এগুলো বর্তমানে মালে মুতাক্বাওওয়িম তথা মুল্যমান বলেছেন, সমস্ত ফুক্বাহায়ে কেরাম বলেছেন। তাই বিক্রিতে সমস্যা নাই। আর কিছু কিছু রাষ্ট্র যদিও বৈধতা দেয়, কিন্তু সেটি মুল্যমান হতে হলে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা দরকার, নতুবা কিছু দেশে চালু হলেই তা মুল্যমান স্বীকৃতি লাভ করে না। এবং তা ধোঁকা, প্রতারণা মুক্ত থাকতে হবে, প্রকাশকের অজ্ঞতাই বড় রিস্কের কারণ! আর এ কথা সঠিক যে টাকার তুলনায় গত একবছর বিটকয়েনের রেট কম আপডাউন করেছিলো। কিন্তু বিটকয়েনের রেট আপডাউনের অবস্থা সবসময়ই ভয়াবহ। এর অস্তিত্ব না থাকার কারণে এখানে বিনিয়োগ পুরাটাই জুয়া। পঞ্চম বিষয়ঃ বিটকয়েন তথা ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যাপারে বিশ্বের গ্রহণযোগ্য ফতোয়া বিভাগগুলো যেমন বিশ্ববিখ্যাত দ্বীনি বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দ, পাকিস্তানের জামিয়া বানুরি টাউন, মিশরের দারুল ইফতাসহ অসংখ্য মুফতি উলামায়ে কেরাম এটাকে নাজায়েজ বলেছেন। "তেজারত কা মাসায়েল কা এনাসাইক্লোপিডিয়া" এর দ্বিতীয় খণ্ডের ৯২ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে : آج کل عالمی مارکیٹ میں ایک کوئن رائج ہے جسے ’’بٹ کوئن‘‘ یا ’’ڈیجیٹل کرنسی‘‘ کہتے ہیں،یہ ایک محض فرضی کرنسی ہے، اس میں حقیقی کرنسی کے بنیادی اوصاف اور شرائط بالکل موجود نہیں ہیں،لہٰذا موجودہ زمانہ میں ’’کوئن‘‘ یا ’’ ڈیجیٹل کرنسی‘‘ کی خرید وفروخت کے نام سے انٹر نیٹ پر اور الیکٹرونک مارکیٹ میں جو کاروبار چل رہا ہے، وہ حلال اور جائز نہیں ہے، وہ محض دھوکہ ہے، اس میں حقیقت میں کوئی مبیع وغیرہ مادی چیز نہیں ہوتی ، اور اس میں قبضہ بھی نہیں ہوتا، صرف اکاؤنٹ میں کچھ عدد آجاتے ہیں، اور یہ فاریکس ٹریڈنگ کی طرح سود اور جوے کی ایک شکل ہے؛ اس لیے ’’بٹ کوئن‘‘ یا کسی بھی ’’ڈیجیٹل کرنسی‘‘ کے نام سے نہاد کاروبار میں پیسے لگانا اور خرید وفروخت میں شامل ہونا جائز نہیں ہے۔ ‘‘(ص:٩٢،ج:٢،حرف باء،بٹ کوئن،ط:بیت العمار،کراچی) "বর্তমানে বিশ্ববাজারে একটি মুদ্রা প্রচলিত রয়েছে, যাকে ‘বিটকয়েন’ বা ‘ডিজিটাল কারেন্সি’ বলা হয়। এটি এক প্রকার কাল্পনিক মুদ্রা, যার মধ্যে বাস্তব মুদ্রার প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য ও শর্ত নেই। এ কারণে বর্তমানে ‘কয়েন’ বা ‘ডিজিটাল কারেন্সি’ নামে ইন্টারনেট ও ইলেকট্রনিক বাজারে যে ব্যবসা চলছে, তা বৈধ নয়। এটি আসলে প্রতারণার শামিল, কারণ এতে কোনো প্রকৃত বস্তুর অস্তিত্ব নেই, এবং হস্তান্তরও সম্ভব হয় না, কেবল অ্যাকাউন্টে কিছু সংখ্যা যুক্ত হয়, যা মূলত ফরেক্স ট্রেডিংয়ের মতো সুদ ও জুয়ার এক ধরণ। তাই ‘বিটকয়েন’ বা যেকোনো ‘ডিজিটাল কারেন্সি’তে বিনিয়োগ করা বা কেনাবেচায় অংশগ্রহণ করা বৈধ নয়।" (পৃষ্ঠা: ৯২, খণ্ড: ২) দারুল উলুম দেওবন্দের কাছে বিটকয়েন সম্পর্কে জানতে চাইলে লম্বা ফতোয়া প্রকাশ করেছে। বিস্তারিত বলেছে। দারুল উলুম দেওবন্দের ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছেঃ "বিটকয়েন বা অন্য কোনও ডিজিটাল মুদ্রা একটি কেবল কল্পনাপ্রসূত মুদ্রা। এর মধ্যে প্রকৃত মুদ্রার মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি নেই। বর্তমানে বটকয়েন বা ডিজিটাল মুদ্রার কেনাবেচার নামে যে ব্যবসা চলছে, তা আসলে একটি প্রতারণা; এর মধ্যে বাস্তবিকভাবে কোনও পণ্য বা বস্তু নেই এবং এই ব্যবসায়ে বেচাকেনার বৈধতার শারীয় শর্তগুলি পাওয়া যায় না। বরং এটি বাস্তবে ফরেক্স ট্রেডিংয়ের মতো সুদ এবং জুয়ার রূপ। সুতরাং, বিটকয়েন বা অন্য কোনও ডিজিটাল মুদ্রার কেনাবেচার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটে চলমান এই ব্যবসা শরিয়া অনুযায়ী বৈধ নয়। অতএব, বিটকয়েন বা অন্য কোনও ডিজিটাল মুদ্রার নামের এই ব্যবসায়ে অংশগ্রহণ করা বা অন্য কাউকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে দেওয়া উচিত নয়। আজকাল বিশ্বের বিভিন্ন মুদ্রাগুলি প্রকৃতপক্ষে সম্পদ নয়; এগুলি কেবল কাগজের টুকরা। এগুলোর মধ্যে যে মূল্য বা পরিচিত মূল্য আছে, তা দুই কারণে হয়; প্রথমত, এর পেছনে দেশের অর্থনৈতিক উপাদান থাকে; এ কারণে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও অবনতি মুদ্রার মূল্যকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ, অর্থনীতির কারণেই দেশের মুদ্রার মূল্য বাড়ে এবং কমে। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি দেশ জনগণের জন্য তাদের মুদ্রার জন্য একটি গ্যারান্টি এবং দায়িত্বশীল থাকে; এ কারণেই যখন একটি দেশ তাদের কোনো মুদ্রা বন্ধ করে, তখন মুদ্রাটি কেবল কাগজের নোট হয়ে যায় এবং এর কোনো মূল্য বা মর্যাদা থাকে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ডিজিটাল মুদ্রার পেছনে কী আছে যার কারণে এর মূল্য নির্ধারিত হয় এবং এর উন্নতি ও অবনতি থেকে মুদ্রার মূল্য বাড়ে এবং কমে? সেই সঙ্গে, এই মুদ্রার গ্যারান্টি ও দায়িত্ব কে? এবং মুদ্রার পেছনে যে কিছু থাকে, তা কি সত্যিকার অর্থে গ্যারান্টির নিয়ন্ত্রণে আছে, নাকি এটি কেবল কাল্পনিক ও প্রতীকী? ডিজিটাল মুদ্রা সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখাগুলি পড়ার পর এবং এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করার পর, জানা গেল যে ডিজিটাল মুদ্রা কেবল একটি কাল্পনিক বিষয়। এর শিরোনাম হাতির দাঁতের মতো, যা কেবল দেখানোর জন্য; এবং বাস্তবে এটি ফরেক্স ট্রেডিংয়ের মতো ইন্টারনেটে চলমান জুয়া ও সুদের ব্যবসার একটি রূপ। এতে প্রকৃতপক্ষে কোনো ক্রিয়াকলাপ বা পণ্য নেই এবং এই ব্যবসায় বাণিজ্যের বৈধতা সম্পর্কিত শরীয়তের শর্তাবলিও নেই। সুতরাং সংক্ষেপে বলা যায় যে, বিটকয়েন বা অন্য কোনো ডিজিটাল মুদ্রা কেবল একটি কাল্পনিক মুদ্রা, এটি বাস্তব এবং প্রকৃত মুদ্রা নয়। এছাড়া কোনো ডিজিটাল মুদ্রায় বাস্তব মুদ্রার মৌলিক গুণাবলী নেই। ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবসায় জুয়া ও সুদের উপাদান স্পষ্টভাবে দেখা যায়; তাই বিটকয়েন বা অন্য কোনো ডিজিটাল মুদ্রার কেনাবেচা বৈধ নয়। একইভাবে, বিটকয়েন বা অন্য কোনো ডিজিটাল মুদ্রার বাণিজ্যও ফরেক্স ট্রেডিংয়ের মতো অবৈধ; সুতরাং এই ব্যবসা থেকে বিরত থাকা উচিত। বাস্তবে এটি ফরেক্স ট্রেডিং ইত্যাদির মতো ইন্টারনেটে চলমান জুয়া ও সুদের ব্যবসার একটি রূপ। এতে প্রকৃতপক্ষে কোনো পণ্য বা সম্পদ নেই এবং এর ব্যবসায় বাণিজ্যের বৈধতা সম্পর্কিত শরীয়তের শর্তাবলিও নেই। সুতরাং, যদি প্রকৃতপক্ষে এটি এমনটাই হয় (যেমন প্রকাশ্যে বোঝা যাচ্ছে), তাহলে নির্দেশ হবে যে ডিজিটাল মুদ্রায় টাকা লগ্নি করা বা এর জন্য কাউকে কোম্পানির সদস্য হিসেবে যুক্ত করা বৈধ নয়; কারণ ইসলামিতে জুয়া এবং সুদের ব্যবসা সম্পূর্ণরূপে হারাম ও অবৈধ। তবে, যদি এই মুদ্রা সত্যিকার অর্থে একটি মুদ্রা হয়ে যায়, কেবল ডিজিটাল না থাকে এবং এর প্রকৃতি সম্পূর্ণভাবে প্রকৃত মুদ্রার মতো হয়ে যায়, তবে এর নিয়ম সাধারণ মুদ্রার মতো হবে।" (১) তবে বিটকয়েনের লেনদেন জায়েজ হতে হলে কিছু শর্ত আছেঃ রাষ্ট্রীয়ভাবে মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃত হতে হবে। জনসাধারন এই লেনদেনের ধোঁকা, প্রতারণা থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ হতে হবে। সহজলভ্য হতে হবে। রেট অস্বাভাবিক রকমের আপডাউন হতে পারবে না, স্থিতিশীল হতে হবে। এর প্রকাশক অজ্ঞাত হতে পারবে না। উপরোক্ত শর্তগুলি পরিপূর্ণ পেতে হবে। সবকিছু পর্যালোচনার পরে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যেঃ বিটকয়েন তথা ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং এজাতীয় ডিজিটাল কয়েনের লেনদেন মৌলিকভাবে জায়েজ নাই। তবে উপরোক্ত শর্তগুলি পূর্ণাঙ্গভাবে পাওয়া গেলে এটিকে মুদ্রা বলে গন্য করা হবে এবং শরয়ী নীতিমালা অনুযায়ি লেনদেন বৈধ হবে।
বিস্তারিত পড়ুন

বিটকয়েনের শরয়ী পর্যালোচনাঃ তৃতীয় পর্ব

Hm Sulayman

১৬ এপ্রিল, ২০২৫

বিটকয়েনের শরয়ী পর্যালোচনাঃ দ্বিতীয় পর্বে বিটকয়েন কেন মুদ্রা নয়, কি কি অসঙ্গতি রয়েছে সেসব বিষয়গুলি তুলে ধরেছি। প্রথম বিষয় হচ্ছে - ফুক্বাহায়ে কেরাম মুদ্রা গণ্য হওয়ার জন্য কিছু শর্ত করেন। তারমধ্যে যেমন - জনসাধারণের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এর প্রচলন শুরু হবে। অর্থাৎ এটির ব্যাপক প্রচলন হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে সেটির বৈধতা থাকার কারণে। খোদ রাষ্ট্রই কোন বস্তুকে মুদ্রার জন্য আখ্যায়িত করবে। যেমন আমাদের দেশে কেন্দ্রিয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে টাকাকে মুদ্রা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর মুদ্রা বা টাকা হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার জন্য এটা অন্যতম শর্ত। এই জন্য হানাফি মাজহাবের এ্যানাসাইক্লোপিডিয়া খ্যাত কিতাব "আল হিদায়া" গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে এই বিষয়ে বলা হয়েছেঃ قوله: ويجوز بيع الفلس بالفلسين باعيانهما عند أبى حنيفة وابى يوسف وقال محمد لا يجوز لأن الثمنية ثبت باصطلاح الكل... بخلاف النقود لأنها للثمنية خلقة অর্থাৎ মুদ্রা পরিগনিত হবে মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রচলন এবং স্বীকৃতির মাধ্যমে। এটা ইমাম মুহাম্মাদ রাহিমাহুল্লাহ এর মত। (আল হিদায়া : ৮১/৩) উল্লেখিত শর্তাবলির কোনটিই পাওয়া যায় না এখানে। তাই এটি মুদ্রাই নয়। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে - এছাড়াও যেটি মুদ্রা হবে, তার অন্যতম একটি বিষয় হলো সেটি মৌলিকভাবে ধোঁকা, প্রতারণা থেকে মুক্ত থাকবে, কোন ঝুঁকির মধ্যে থাকবে না। কিন্তু বিটকয়েন এটি জুয়ার মতই এবং ধোঁকা খাওয়া প্রতারিত হওয়ার সমুহ সম্ভাবনা রয়েছে। এটি রাতারাতি পরিবর্তন হয়,দাম আকাশছোয়া হয়, আবার কমে যায়, এবং এই কয়েন অনেক সময় হ্যাক হয়ে যায়। অথচ এরকম লেনদেন মানব জীবনে বড় বিপর্যয়ের কারণ। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ قال اللّٰہ تعالی: یٰأیھا الذین آمنوا إنما الخمر والمیسر والأنصاب والأزلام رجس من عمل الشیطن فاجتنبوہ لعلکم تفلحون ( المائدة، ۹۰) “হে বিশ্বাসীরা! নিঃসন্দেহে মদ, জুয়া, মূর্তিপূজা এবং ভাগ্য নির্ধারণের তাস-প্রথা শয়তানের কাজ; সুতরাং এগুলি থেকে দূরে থাকো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।” (সুরা মায়েদা: ৯০) অপর এক আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ ﴿وَلَا تَأْکُلُوْا أَمْوَالَکُمْ بَیْنَکُمْ بِالْبَاطِلِ﴾ أي بالحرام، یعني بالربا، والقمار، والغصب والسرقة (معالم التنزیل ۲: ۵۰) “আর নিজেদের মধ্যে অগ্রহণযোগ্য উপায়ে (অর্থাৎ হারাম উপায়ে) তোমাদের সম্পদ খাবে না।” অর্থাৎ সুদ, জুয়া, দখল ও চুরি। (মাআলিমুত তানযিল : ৫০/২) জুয়ার ভয়াবহতা বর্ণনা করতে যেয়ে আল্লামা শামি রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ ، لأن القمار من القمر الذي یزداد تارةً وینقص أخریٰ۔ وسمی القمار قمارًا؛ لأن کل واحد من المقامرین ممن یجوز أن یذہب مالہ إلی صاحبہ، ویجوز أن یستفید مال صاحبہ، وہو حرام بالنص (رد المحتار، کتاب الحظر والإباحة، باب الاستبراء، فصل في البیع، ۹: ۵۷۷، ط: مکتبة زکریا) কারণ জুয়া এমন একটি বিষয়, যা একবার বাড়ে, একবার কমে। জুয়াকে জুয়া বলা হয়; কারণ প্রতিটি জুয়াড়ির জন্য অনুমোদিত যে তার সম্পদ অন্যের কাছে চলে যেতে পারে এবং অন্যের সম্পদ থেকে লাভ গ্রহণ করা যেতে পারে। এবং এটি স্পষ্টতই হারাম। (রদ্দুল মুহতার: ৫৭৭/৯) তৃতীয় আরেকটি বিষয় হলো - বিটকয়েনকে যদি মুদ্রা ধরেও নিই (যদিও এটি মুদ্রা নয়) এবং টাকার বিনিময়ে যদি এটাকে ক্রয় করতে হয়, তাহলে এটি শরয়ী পরিভাষায় "বাইয়ুস সারফ" তথা যে চুক্তিতে উভয় পক্ষেই মুদ্রা-দ্রব্য থাকে। এখন যদি বিটকয়েনকে বিটকয়েনের মোকাবেলায় বিক্রি করা হয় তাহলে সেখানে মজলিসেই উভয় পক্ষেরই তা হস্তগত করা আবশ্যক। যেমনটা হেদায়ার মধ্যে এসেছেঃ قوله: وعقد الصرف ما وقع على جنس الاثمان يعتبر فيه قبض العوضيه فى المجلس ....وما سواه مما فيه الربوا يعتبر فيه التعيين ولا يعتبر فيه التقابض "বাইয়ুস সারফের মধ্যে চুক্তির মজলিসেই হস্তগত করা আবশ্যক" (হেদায়া : ৮০/৩) আর বিটকয়েনকে ভিন্ন দেশের কারেন্সির বিনিময়ে বিক্রি করলে মাসআলা হলো: এক দেশের কারেন্সি আরেক দেশের কারেন্সির বিনিময়ে কম-বেশি করে বিক্রি করা জায়েজ আছে। তবে সেক্ষেত্রেও বৈঠকেই কমপক্ষে একপক্ষকে টাকাটি হস্তগত করে নিতে হবে। যদি একজনও তাদের বিনিময়কৃত কারেন্সি হস্তগত না করে, তাহলে ক্রয়-বিক্রয়টি জায়েজ হবে না। (জাদিদ ফিকহি মাসায়িল: ৪/২৮; জাদিদ মুআমালাত কে শরয়ি আহকাম: ১-১৩৯) কিন্তু সেটা বিটকয়েনে পাওয়া যায় না। এছাড়াও বিটকয়েন কখনোই স্বর্ণ রৌপ্যের স্থলাভিষিক্ত নয়, যেমনটা প্রচলিত টাকা পয়সা। বিটকয়েনের ট্রানজেকশন, লেনদেন সবকিছুই অজ্ঞাত, এটি সহজলভ্য নয়,সব মানুষ এটা ব্যাবহার করতে পারে না, যেটা শরয়ী কারেন্সি নীতি বহির্ভূত বিষয়। তাছাড়া এটি অজ্ঞাত এবং এর পরিচালক জানা যায় না, তাই মানুষের সম্পদ সম্ভাব্য ঝুঁকির মধ্যেই থাকে, যা শরীয়তে নিষেধ। যেহেতু এই মুদ্রা শুধু মাত্র ইলেক্ট্রোনিক্যালি জমা থাকে, তাই আপনার কম্পিউটার বা কম্পিউটিং ডিভাইজ যদি ক্র্যাশ হয়ে যায় কিংবা আপনি যদি অ্যাকাউন্ট পাসওয়ার্ড ভুলে যান তবে, আপনার সকল কয়েন গায়েব হয়ে যাবে। এবং আপনি কখনোই এই কয়েন গুলো রিকভার করতে পারবেন না। বিটকয়েন লেনদেন পুনরাবৃত্তি না করতে না পারা, সেবা গ্রহিতা সংশ্লিষ্ট সেবা না পেলে, মুদ্রা ফেরত পাওয়ার কোন উপায় নেই।
বিস্তারিত পড়ুন

বিটকয়েনের শরয়ী পর্যালোচনাঃ দ্বিতীয় পর্ব

Hm Sulayman

১৬ এপ্রিল, ২০২৫

বিটকয়েন মুলত কি, ক্রিপ্টোকারেন্সি কাকে বলে - এসবের বাস্তবতা নিয়ে বিটকয়েনের শরয়ী পর্যালোচনাঃ প্রথম পর্বে কমবেশি লেখা হয়েছে। এখন আমরা বিটকয়েন/ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের শরয়ী বিধান নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। বিটকয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন এটি আদতে বৈধ নাকি অবৈধ এটি নির্ভর করবে বিটকয়েনের সত্ত্বার উপর বিবেচনা করে। এটি মুলত কি? এটি কি কোন মুদ্রা? এটি কি বিনিময়যোগ্য? ইত্যাদি বিষয় সামনে আসবে। দেখুন, এই বিটকয়েন লেনদেন বৈধ হতে হলে সবার পূর্বে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করতে হবে, যাচাই করতে হবে। বিটকয়েনের ব্যাপারে যাচাই করার মত বেশ কয়েকটি বিষয় সামনে এসেছে। তারমধ্যে মৌলিকভাবে উল্লেখযোগ্য হলোঃ বিটকয়েন প্রকাশকের অজ্ঞতা। এটির প্রকাশক কে বা কারা, নিয়ন্ত্রন করা করে জানা যায় না। এর ভবিষ্যত বিষয়ে অজ্ঞতা। এটির স্থায়িত্ব বা গ্যারান্টি নিয়ে সংশয় রয়েছে। এর প্রাতিষ্ঠানিক কোন প্রকাশক নেই। কেন্দ্রিয়ভাবে এর দ্বায়ভার বা যিম্মাদারও নেই। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণ নেই। এর কোন সেন্ট্রালাইজড কন্ট্রোল নাই। এতে ব্যাপকভাবে স্প্যাকুলেশন হয়। এর মূল্য স্থীর থাকে না। রাতারাতি দামে আপডাউন হয়। আইন বহির্ভূত কাজে অধিক ব্যবহার হওয়া। উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি শরীয়তের দৃষ্টিতে মালে মুতাকাওয়্যিম তথা মূল্যমান বিশিষ্ট হবে কিনা তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। উপরের প্রত্যেকটি বিষয়ই বিটকয়েন জায়েজ-নাজায়েজ হওয়ার ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্ব বহন করে। কেননা উপরোল্লেখিত বিষয়ের দ্বারাই কোন বস্তু লেনদেনের যোগ্যতা অর্জন করতে পারে অথবা হারিয়ে ফেলে। কোন বস্তু লেনদেনের যোগ্যতা অর্জন শরীয়ত সম্মত পন্থায় বিনিময় করতে গেলে তাকে মুল্যমান সমৃদ্ধ বস্তু হতে হবে। কিন্তু উক্ত বিষয়গুলো বিটকয়েনের মধ্যে পাওয়ার কারণে বিটকয়েন তার শরয়ী বিনিময় যোগ্যতা বা মুল্যমান হারিয়ে ফেলেছে। বিটকয়েন আসলে পারিভাষিক দৃষ্টিকোন তথা বাস্তবতার বিবেচনায় কোন স্বীকৃত মুদ্রা নয়। যদিও এর দ্বারা চলমান বিশ্বে লেনদেনের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। মুদ্রা হতে হলে বেশকিছু বিষয়ের প্রতি ফোকাস রাখা আবশ্যক। এব্যাপারে আইএফএ কনসালটেন্সি এর মুফতি আবদুল্লাহ মাসুম হাফিজাহুল্লাহ হাফিজাহুল্লাহ মুদ্রার পরিচয় দিতে যেয়ে বলেনঃ অর্থনীতিবিদ ও ফকীহদের দৃষ্টিতে মুদ্রার চারটি বৈশিষ্ট্য ও অর্থনৈতিক কাজ (Economic Activities) রয়েছে। যথা- Medium of Exchange: এর সারকথা হল, যে জিনসটি মুদ্রা হবে তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হবে-যেকোন কিছু ক্রয়-বিক্রয়ে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে তা কাজ করবে। Widely Acceptable: এর সারকথা হল, যে জিনিষটি মুদ্রা হবে সেটার জন্য জরুরী হল-তা ব্যাপকভাবে কোনও প্রকার দলীল-প্রমাণ ছাড়া গ্রহণযোগ্য হওয়া। এর বিপরীতে কাংখিত বস্তু দিতে প্রস্তুত হওয়া। এর জন্য একটি অন্যতম শর্ত হল, দেশীয় আইনে তা অস্বীকার না করা। Standard of Value/Measure of Value: এর সারকথা হল, কাপড়ে দীর্ঘতা মিটার বা গজে মাপা হয়। চাউল-গমের পরিমাণ ওযনের মাধ্যমে জানা যায়। তেমনি এসব বস্তুর ভেল্যু পরিমাপ করার মাধ্যম হল মুদ্রা। অর্থাৎ যে জিনিষটি মুদ্রা হবে তার মধ্যে এই গুণ থাকতে হবে যে, এর মাধ্যমে বস্তুসমূহের ভ্যল্যু সহজেই নির্ণয় করা সম্ভব হবে। যেমন, বলা হয় ঘড়িটির মূল্য দুইশত টাকা। বইটির মূল্য তিনশত টাকা। Store of Value: এর সারকথা হল, মানুষ সম্পদ সঞ্চয় করে। ভবিষ্যতে তা কাজে আসে। সম্পদ সঞ্চয়ের জন্য এমন কিছু দরকার, যার মূল্যমান সাধারণত হ্রাস হবে না। নষ্ট হবে না। এর দ্বারা নিজ সম্পদের ভ্যাল্যু সংরক্ষণ করা যাবে। এটি করার মাধ্যম হল-মুদ্রা। এক লক্ষ টাকা আপনার কাছে থাকার অর্থই হল, এ পরিমাণ সম্পদের ভ্যাল্যু আপনার কাছে আছে। অর্থাৎ যে জিনিষটি মুদ্রা হবে তার মধ্যে এই গুণ থাকতে হবে যে, এর মাধ্যমে বস্তুসমূহের ভ্যাল্যু সহজেই সংরক্ষণ করা যায়। সারকথা, এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, কোন কিছুকে মুদ্রা বলতে হলে আগে দেখতে হবে তার মধ্যে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো আছে কি না। কোন একটা বৈশিষ্ট্য না থাকলে সেটা মুদ্রা হবে না। আলোচিত বিটকয়েনে-অন্তত আমাদের দেশে-দ্বিতীয় গুণটি নেই। কারণ এটি ব্যাপকভাবে গৃহিত নয়। সরকারীভাবেও অনুমোদিত নয়। সুতরাং একে আমাদের দেশে শরঈ ও অর্থনীতি কোন দৃষ্টিকোণ থেকেই কারেন্সি বা মুদ্রা বলা যায় না। বিশেষত সরকারীভাবে এর লেনদেন আমাদের দেশে নিষিদ্ধ। শরীয়তের মাসয়ালা হল, বৈধ বিষয়ে রাষ্ট্রের আনুগত্য করা ওয়াজিব। এর জন্য রাষ্ট্র ইসলামী হওয়া জরুরী নয়। আরো সংক্ষেপে বললে, বিটকয়েন শরঈভাবে নিষিদ্ধ হওয়ার মৌলিক কারণ তিনটি। যথা- গারার তথা ধোঁকা (Uncertainty), জাহালাহ (অজ্ঞতা) ও গ্যামব্লিং। মূলত বিটকয়েনের প্রকাশকের অজ্ঞতা, এর ভবিষ্যত বিষয়ে অজ্ঞতা, এটি সেন্ট্রালাইজড না হওয়া, তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণ না হওয়া থেকেই এসব গারার ও জাহালাহ-এর সৃষ্টি। নিষিদ্ধ কাজের মাধ্যম হওয়া। এসব বৈশিষ্ট্যসমূহের কারণে শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি মূল্যমান বিশিষ্ট সম্পদ না হওয়া। উপরোক্ত বিষয় থেকে বেশকিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়। বিশেষত মুদ্রার যেই বৈশিষ্ট সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া এই মুদ্রার কোন গ্যারান্টার নাই। এই মুদ্রার দাম আপ-ডাউনের ক্ষেত্রে সীমাতিরিক্ত। স্থিতিশীল নয়। মুদ্রার যেই শরয়ী পরিচয় তার তেমন কিছুই নেই এরমধ্যে। শরীয়তে কোন পণ্যের বিনিময় মুল্য হিসেবে স্বর্ণ এবং রুপাকে মুল মুদ্রা হিসেবে ধর্তব্য করা হয়েছে। তাই ইসলামে মুদ্রা ব্যবস্থা বলতে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রাকে বুঝানো হয়ে থাকে। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে নিয়ে সব খলিফা ও সুলতানদের আমলে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন ছিলো সর্বসাকুল্যে। কাগজের মুদ্রা ব্যবস্থা আসার আগ পর্যন্ত স্বর্ণের বা রূপার কয়েন ছিলো সকল মুসলিমের মুদ্রা। কাগজের মুদ্রার প্রচলন হওয়ার পর থেকে সেটা আর থাকেনি। কাগজের মুদ্রা গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার পেছনে যে কারণটি ছিলো সেটি হলো, গ্রাহকের হাতে থাকে কাগজের মুদ্রাটি কেবল মূল স্বর্ণ বা রৌপ মুদ্রার এভিডেন্স। এর অর্থ হলো গ্রাহকের হাতে থাকা কাগজের মুদ্রার বিপরীতে জাতীয় ব্যাংকে স্বর্ণ বা রৌপ্য গচ্ছিত রয়েছে। তার প্রমাণ হিসাবে গ্রাহক কেবল কাগজকের এই নোটগুলো বহন করছে। এ জন্যই কাগজের নোটের মধ্যে লেখা থাকে "চাহিবা মাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে।" সেই সাথে মূল মুদ্রা দ্বারা যেসব কাজ করা যেতো এই কাগজের মুদ্রা দ্বারা সে সব কাজ কারার এখতিয়ার জাতীয় ব্যাংক দিয়ে রেখেছে। চোর ডাকাত ছিনতাইকারীর হাত থেকে নিজের অর্থগুলোকে রক্ষা করার একটি কার্যকরী উপায় হয়ে ওঠে কাগজের মুদ্রা। তাই সকলে এটি গ্রহণ করে নেয়। বিপরীতে বিটকয়েনের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা, নিশ্চয়তা এসবের কিছুই নাই। বরং এটি শুধুমাত্র স্ক্রিনে প্রদর্শিত একটি সংখ্যা মাত্র। এটি মুলত অস্তিত্বহীন। শরীয়তে এজাতীয় জিনিস লেনদেনের মাধ্যম হতে পারে না। যেমন ফতোয়ায়ে আলমগিরির মধ্যে এসেছেঃ "أن يكون موجودا فلا ينعقد بيع المعدوم وما له خطر العدم كبيع نتاج النتاج والحمل كذا في البدائع."(ص:٢،ج:٣،کتاب البیوع، الباب الأول،ط:دار الفكر،بيروت) "যেটি ক্রয় বিক্রয় করা হবে, সেটি অস্তিত্বে থাকা, বিদ্যমান থাকা। (অর্থাৎ যে বস্তু অস্তিত্বে আছে তা-ই বিক্রয়যোগ্য।) সুতরাং অস্তিত্বহীন বস্তু বা যা অনুপস্থিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যেমন: প্রাণীর গর্ভস্থ সন্তান বা অনাগত ফল, এসব বিক্রয় বৈধ নয়।" (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: পৃষ্ঠা: ২, খণ্ড: ৩, কিতাবুল বয়ূ, প্রথম অধ্যায়, প্রকাশক: দারুল ফিকর, বৈরুত) এজাতীয় জিনিস ক্রয় বিক্রয়ের বস্তু হতে পারে না। তাছাড়া এটি হস্তান্তরযোগ্য নয়। অথচ ক্রয় বিক্রয়ের অন্যতম শর্তই হচ্ছে যে বস্তু হস্তান্তরযোগ্য হতে হবে। যেমন বাদাইয়ুস সানাই কিতাবের মধ্যে আল্লামা ইবনে নুজাইম রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ "(ومنها) أن يكون مقدور التسليم عند العقد، فإن كان معجوز التسليم عنده لا ينعقد، وإن كان مملوكا له." (بدائع الصنائع: ص:١٤٧،ج:٥،کتاب البیوع،فصل فی الشرط الذی يرجع إلي المعقود عليه،ط:دار الكتب العلمية) "ক্রয় বিক্রয় চুক্তি সহীহ হওয়ার শর্তসমূহের মধ্যে অন্যতম শর্ত হলো, চুক্তির সময় সম্পত্তি হস্তান্তরযোগ্য থাকতে হবে। যদি চুক্তির সময় সম্পত্তি হস্তান্তরের সামর্থ্য না থাকে, তবে সেই চুক্তি বাতিল হবে, যদিও তা চুক্তিকারীর মালিকানায় থাকে।" (বাদাইয়ুস সানাই: পৃষ্ঠা: ১৪৭, খণ্ড: ৫, দারুল কুতুবুল ইলমিয়্যাহ) আল্লামা ইবনুল হুমাম রাহিমাহুল্লাহ ফাতহুল কাদিরের মধ্যে বলেছেনঃ "قال (ولا بيع الطير في الهواء) لأنه غير مملوك قبل الأخذ، وكذا لو أرسله من يده لأنه غير ‌مقدور ‌التسليم. (قوله ولا بيع الطير في الهواء؛ لأنه قبل أخذه غير مملوك، وبعد أخذه وإرساله غير ‌مقدور ‌التسليم) عقيب العقد، ثم لو قدر على التسليم بعد ذلك لا يعود إلى الجواز عند مشايخ بلخ، وعلى قول الكرخي يعود، وكذا عن الطحاوي (ص:٤١٠،ج:٦،کتاب البیوع،باب البیع الفاسد،ط:دار الفکر،بیروت) "বাতাসে থাকা পাখি বিক্রয় করা যাবে না, কারণ এটি ধরা পড়ার আগে মালিকানাধীন নয়, আর ধরার পর হাত থেকে ছেড়ে দিলে সেটি হস্তান্তরযোগ্য থাকে না। যদি পরবর্তীতে হস্তান্তর সক্ষম হয়, তবু বালখের (একটি এলাকার নাম) মাশায়েখদের মতে এটির বৈধতা ফিরে আসবে না, যদিও ইমাম কারখী ও ইমাম ত্বহাভি রাহিমাহুমাল্লাহ এর মতে ফিরে আসবে। (পৃষ্ঠা: ৪১০, খণ্ড: ৬, দারুল ফিকর, বৈরুত) আল্লামা ইবনু নুজাইম রাহিমাহুল্লাহও একই কথা বলেছেনঃ "(قوله والطير في الهواء) أي لا يجوز لأنه غير مملوك قبل الأخذ فيكون باطلا، وكذا لو باعه بعد ما أرسله من يده لأنه غير ‌مقدور ‌التسليم فيكون فاسدا، ولو أسلمه بعده لا يعود إلى الجواز عند مشايخ بلخ، وعلى قول الكرخي يعود، وكذا عن الطحاويأطلقه فشمل ما إذا جعل الطير مبيعا أو ‌ثمنا."(ص:٨٠،ج:٦،کتاب البيوع،باب البيع الفاسد،ط:دار الکتاب الإسلامي) ( আল বাহরুর রায়িক: ৮০/৬, দারুল কুততুবুল ইলমিয়্যাহ) উপরের দুই রেফারেন্স দ্বারা বোঝা গেলো যে হস্তান্তরযোগ্য নয় এবং অস্তিত্বহীন জিনিস ক্রয় বিক্রয় বৈধ নয়। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে : এই মুদ্রার দাম আপ-ডাউনের ক্ষেত্রে সীমাতিরিক্ত। স্থিতিশীল নয়। এর ফলে গ্রাহক সর্বচ্চো ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। মিনিটে মিনিটে এর দাম আপডাউন হতে পারে। আর এর দ্বারা গ্রাহকের ক্ষতি সুনিশ্চিত। আর শরীয়তে এমন কোন লেনদেনের রাস্তা রাখেনি, যার কারণে মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তৃতীয় বিষয় হচ্ছেঃ বিটকয়েন কোনভাবেই মুদ্রা হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। কারণ টাকা নিজেই বিনিয়োগের জায়গা হয় না, বরং টাকা দিয়েই কোন বস্তুর ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা হয়। পক্ষান্তরে আপনি যদি বিটকয়েনকে মুদ্রা বা টাকা বলে গন্য করেন: বিটকয়েন সেক্ষেত্রে বিনিয়োগের জায়গা, সেখানে ইনভেস্ট করা যাচ্ছে, যেটা তাকে মুদ্রা হওয়া থেকে বের করে দেয়। তাছাড়া এর মধ্যে জুয়া বা ধোঁকার মত রয়েছে। কারণ এটি কাদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করছে বা এর ভ্যালিডিটি কি তার কোন নির্ভরযোগ্যতা নাই। সর্বপোরি এসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখলে বোঝা যায় যেঃ বিটকয়েনের লেনদেন শরয়ীভাবে বিধিবদ্ধ নয়, জায়েজ নয়।
বিস্তারিত পড়ুন

বিটকয়েনের শরয়ী পর্যালোচনাঃ প্রথম পর্ব

Hm Sulayman

১৬ এপ্রিল, ২০২৫

ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং বিটকয়েনের পরিচয়, বাস্তবতা বর্তমান সময়ে অনলাইনে সবচাইতে জনপ্রিয় বহুল আলোচিত একটি লেনদেনের নাম হচ্ছে ক্রিপ্টোকারেন্সি। ক্রিপ্টোকারেন্সির অনেকগুলো লেনদেন পদ্ধতি আছে। ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম এটা। যেমন বিটকয়েন, ইথেরিয়াম, লাইট কয়েন, রিপল, বিনান্স কয়েন সহ ক্রিপ্টোকারেন্সির আরো একাধিক প্রকার আছে। ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেনের মধ্যে বিটকয়েন সবচাইতে বহুল প্রচলিত এবং লাভজনক(!) কিন্তু প্রতিটি লেনদেন বুঝতে হলে, শরীয়ত সম্মত হতে হলে সর্বপ্রথম সেটার পরিচিতি, প্রকারভেদ এবং পদ্ধতি জানা আবাশ্যক। আমরা আজকের এই পর্বে মৌলিকভাবে ক্রিপ্টোকারেন্সি কাকে বলে, তার প্রকৃতি কি, এর প্রতিষ্ঠাতা কে এবং এর প্রকারভেদ, লেনদেন সিস্টেম নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। ক্রিপ্টোকারেন্সির পরিচয় ক্রিপ্টোকারেন্সি হল একটি নতুন লেনদেনের উপায়। বলা যেতে পারে ক্রিপ্টোকারেন্সি হল একপ্রকার Digital Currency Of Cash। Crypto শব্দ টির অর্থ হল Secret বা গোপন এবং Currency শব্দের মানে হল অর্থ যার বিনিময়ে বিভিন্ন পণ্যের আগান প্রদান করা হয়। ক্রিপ্টোকারেন্সি এর অর্থ হলো গোপনঅর্থ। ক্রিপ্টোকারেন্সি হল একটি Encrypted Currency যেখানে লেনদেন সম্পূর্ণ গোপন থাকে এবং এর উপরে কোনো তৃতীয় ব্যক্তির হাত থাকে না। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সরকারের হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। এটিই এই লেনদেনের বৈশিষ্ট। ১৯৮৩ সালে এই ক্রিপটোকারেন্সি বা গুপ্ত মুদ্রা সূচনা হয়েছিল। এখন সবচাইতে ফেমাস লেনদেনে পরিণত হয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে - ক্রিপটোকারেন্সি নোট বা কয়েনের মতো ছাপা কোনো আক্ষরিক সংখ্যা নেই। অর্থাৎ সহজে বললে এমন একটি মুদ্রা, যা অদৃশ্য, সংকেত বা নাম্বারের মাধ্যমে প্রকাশ পায়, এর না আছে নিজস্ব বস্তুগত কোন আকার, না তা স্পর্শযোগ্য। তেমনিভাবে এর না আছে নিজস্ব কোন মূল্যমান বা উপকারিতা (Intrinsic Value)। এটি ডিজিট আকারে অনলাইনে থাকায় একে ডিজিটাল মানি বা ভার্চুয়াল মানি বা ইলেক্ট্রনিক মানি বলা হয় ক্রিপটোকারেন্সির মধ্য দিয়ে আপনি পণ্য কেনাবেচা করতে পারবেন কিন্তু এটিকে ব্যাংকে বা লকার বা আপনি আপনার পকেটে নিয়ে ঘুরতে পারবেন না। ক্রিপ্টো কারেন্সির একটি ভ্যালু রয়েছে যা অন্যান্য কারেন্সি এর ভ্যালুর থেকে কয়েক হাজারগুণ বেশি আবার কম হতেও পারে। এই নির্ভর করে তার জনপ্রিয়তার উপর। ক্রিপটো কারেন্সি এর ভ্যালু অপরিবর্তিত থাকে না, এর ভ্যালু সর্বদা উঠানামা করে। যার ফলে একদিনে ক্রিপটোকারেন্সির ভ্যালু নানান রকমের হতে পারে। ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যাবহারের বিভিন্ন দিক রয়েছে। ক্রিপ্টো মুদ্রা দিয়ে আপনি পন্য কেনাকাটা করতে পারবেন। ক্রিপ্টো মুদ্রা দিয়ে আপনি অনলাইনে লেনদেন করতে পারবেন। ক্রিপ্টো কারেন্সিকে আপনি দেশ-বিদেশে আদান প্রদান করতে পারবেন। এই ক্রিপ্টোকারেন্সি একটা কোম্পানির মত। যার অনেকগুলো মুদ্রা রয়েছে। সেই ক্রিপ্টো মুদ্রার একটি হলো বিটকয়েন। বিটকয়েনের পরিচয় মোটামুটি স্পষ্ট। বিটকয়েন ক্রিপ্টোকারেন্সিরই একপ্রকার মুদ্রা। যেটা স্ক্রিনে সাংকেতিক চিহ্নের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়। এটি ভার্চুয়াল মুদ্রা, বাস্তবিক অর্থে কোন অস্তিত্ব নাই,এর কোম্পানি তাকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে তৈরী করেছে। বিটকয়েনের কোন নিজস্ব ফেসভ্যালু নেই। আমাদের দেশে যেমন মুদ্রা/টাকা তৈরী হয় সরকারি নিয়ন্ত্রণে, মেশিনে। এবং আদান প্রদানের সময় এর যাবতীয় রেকর্ড সরকারি ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। যার ফলে মানি লন্ডারিং করাটাও টাফ ব্যাপার। তাছাড়া আদানপ্রদানে দেরিও হয়। সমস্ত ঝামেলা থেকে বাঁচতে এবং অবৈধ পথ অবলম্বন করতে ক্রিপ্টোকারেন্সি দারুন ভুমিকা রাখে। ক্রিপ্টোকারেন্সির মুদ্রা তথা বিটকয়েন তৈরীর প্রসেস সম্পূর্ণ ভিন্ন। ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্লকচেইন এর মাধ্যমে কাজ করে। চেইন কথার অর্থ হলো শিকল। সহজ ভাষায় বললে ব্লকচেইন হল একটি চেনের মধ্যে অনেকগুলি ব্লকের সংযুক্ত অবস্থা। যখন ক্রিপটোকারেন্সিতে লেনদেন করা হয় তখন লেনদেনের সমস্ত তথ্য রেকর্ড করে রাখা হয় অর্থাৎ একটি ব্লকে লেনদেনের তথ্য নিরাপত্তার সহিত রাখা হয়। এবং লেনদেন দ্রুত হয়। বিটকয়েন হচ্ছে ভার্চুয়াল টোকেনের মত। যেমন দারাজে ব্যাবহার করি। যার ফলে এটির ব্যাবহার বাড়ছে প্রচুর আকারে। এই ছিলো মোটামুটি বিটকয়েন, ক্রিপ্টোকারেন্সির পরিচয়। (বিভিন্ন তথ্য অনলাইন থেকে সংগৃহীত, পরিমার্জিত, সংশোধিত)
বিস্তারিত পড়ুন

সকল প্রসঙ্গ

© ২০২৫ শরয়ী সমাধান - সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

Facebook Group